আমায় গেঁথে দাওনা মাগো
একটি পলাশ ফুলের মালা ।

কী মায়া জাগানো আবেগময় একুশের গান । বসন্তে পলাশ ফুলের আগুন রঙা রূপ যে কারো মন মুগ্ধ হয়ে ওঠে । পাখির কলকাকলিতে চারদিক মুখর হয়ে ওঠে ফাগুনের উতল হাওয়া । ইংরেজি মাস ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস পলাশের আগুন ঝরা দিন ।চোখ জুড়ানো সবুজ বনের মাঝে পলাশের হাসি দেখে মনে হয় সবুজের বুকে আগুন লেগেছে । কত দুর থেকে দেখা যায় সে উজ্জল আগুন । এ জন্যেই বোধ হয় পলাশকে বলা হয় অরন্যের অগ্নিশিখা । নদীর ধারে, রাস্তার পাশে, বনের ধারে, গ্রামে গ্রামান্তরে পলাশ ফুল জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে ।



পাতা শূন্য ডালে থোকায় থোকায় ফুল ফুটে থাকে । খুব সাধারন গাছটি, যতক্ষন না পাতা ঝরে কঙ্কাল হচ্ছে ততক্ষন ফুল ফোটার নাম নেই । সবজে রঙ কালো কালো কুড়ির ভিতর থেকে প্রস্ফুটিত হয় ফুলটি । পাপড়ির একটার নিচে গেরুয়া রঙ অন্যদিকটি সাদাটে লাল । রঙটা ঠিক কেমন ? সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্তের সময় আকাশের রঙটা মনে পড়ে যায় ।

ভোর রাতে গাছের তলায় শিউলী বিছানো দেখলেই পূজোর কথা মনে হয়, তেমনি পলাশ দেখে বুঝে যাই বসন্ত জাগ্রত দ্বারে । পলাশের সৌন্দর্য  মানুষের মন কে মুগ্ধ , করে রোমাঞ্চিত ।
পলাশ পর্ণ মোচী বৃক্ষ জাতীয় ফুল গাছ ।এ গাছের উচ্চতা প্রায় ১২-১৫ মিটার । শাখা প্রশাখায় সামনে ফুল ফুটে থাকে ফুল দেখতে কাঁকড়ার পাঞ্জার মতো ।এ গাছ শিমগোত্রীয়, বাকল ধুসর, শাখা প্রশাখা ও কান্ড আকাঁবাকাঁ । নতুন পাতা রেশমের মতো সূক্ষ্ম ।গাড় সবুজ পাতা ত্রিপত্রী, দেখতে অনেকটা মান্দার গাছের পাতার মতো হলেও আকারে বড় ।শীত মৌসুমে সমস্ত পাতা ঝরে যায়, দেখা যায় গাড় কমলা থেকে হালকা লাল রঙের ফুলের সমারহ, এর পর গ্রীষ্মে ফুল ঝরে সমস্ত গাছের শাখায় শীম স্বাদৃশ্য ফল দেখা যায়, সাথে নতুন হালকা সবুজ পাতা । বীজ ও ডাল কাটিং এর মাধ্যে হয় পলাশ গাছের বংশ বিস্তার ।

পলাশ ফুলে মধু আছে । সে মধুর লোভে ভিড় জমায়, বিভিন্ন ঠোট লম্বা পাখি,উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি, মৌমাছি, ভোমরা । পলাশের কালচে সবুজ সবুজ বৃন্তের মধ্যেই আছে আশ্চর্য  মধু ।মধুর খোঁজার লড়াইয়ে পিউ কাঁহা পাখির সাথে কাঠবিড়ালির ছোটা ছুটি এ ডাল থেকে ও ডালে ।
কুমুদিনীর আরবোরিয়ামে গাছ জোড়া পলাশ লৌহজং নদীর পাড়ে ফুলের দৃশ্য নদীর জলে জলছবি হয়ে ভাসছে । কী নৈসর্গীক দৃশ্য, না দেখলে সে কেবল কল্পনায় থেকে যাবে ।
সুনসান প্রকৃতি, ভোর বেলায় হাঁটতে বেরিয়ে পলাশ তলায় খানিক্ষন বসে থাকলাম সিমেন্টে বাঁধানো রাস্তায় বাগানের পাশ ঘেষে । বসন্ত হাওয়ায় টুপ টাপ ঝরছে পলাশ । কুড়িয়ে আঁচলে তুলি, মালায় গেঁথে গলায় পরি । ভোরের নৈশব্দ ভেঙ্গে শুধু শুনতে পাচ্ছি পলাশ খসে পড়ার শব্দ ।কী মধুর সুরে পিউ কাঁহা ডাকছে । হদয়ে হাহাকার এনে দেয় সেই ডাক- নিজেকে হারিয়ে ফেলি । নদী থেকে শুরু করে কত কিছই না হারাচ্ছে আমাদের প্রকৃতি থেকে কিন্তু শিউলী, পলাশ, শিমুল অথবা পলাশ বনে পাখির গান এখনো বেচেঁ রয়েছে- এ আমাদের পরম ভাগ্য ।
গুন গুন করে গলায় সুর এসে ভিড়ে “শুধু তোমার জন্য এ অরন্যে পলাশ হয়েছে লাল ।”
পলাশ ফুলের সাথে সরস্বতী পুজোর রয়েছে এক আমোঘ সম্পর্ক । দোল উতসবের সাথেও রয়েছে মধুর যোগাযোগ । সবচেয়ে বড় মেল বন্ধন রোমাঞ্চের ।

শিলিগুড়িতে গিয়ে শুনেছিলাম মনিপুরী ভাষায় পলাশকে বলে ”পাঙগোঙ” আর সংস্কৃতে ফুলটির নাম কিংশুক ।পুরানে শুক যে পাখি- তার ঠোট দেখতে পলাশ ফুল যেমন । কি মিস্টি নাম ।নজরুল ইসলামের কাছে কে আবদার করেছে কে জানে ওমনি গান লিখে দিয়েছেন ।
“হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নইলে বাঁধবো না
বাঁধবো না চুল ।”

ও দিকে রবীন্দ্রনাধ আপন মনে গাইছে
ওরে পলাশ, ওরে পলাশ
রাঙা রঙের শিখায় শিখায়
দিকে দিকে আগুন জ্বালাস ।”

কবি গুরু র অসাধারন গান  - “ওরে গৃহবাসী “
রাঙা হাসি
রাশি রাশি
অশোক পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে
মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে
রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥

পলাশের আদি নিবাস মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ায় প্রচুর দেখা যায় ।
পলাশ শুধুই কবিতা ও সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়, বহুবিধ ব্যবহার আছে পলাশের ।
ঔষধ, রং, কাঠ, আঠা ,লাক্ষা কীটের পোষক গাছ হিসাবে কুসুম গাছের পরেই এই গাছের ব্যবহার আছে ।সনাতন  ধর্ম এই গাছকে পবিত্র মানে, এই গাছের তিন পাতা কে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এর প্রতীক হিসাবে মানে ।
পলাশ ফুলের বিজ্ঞানিক নাম Butea monosperma, Butea নামটি বোটানিস্ট John Stuart, 3rd Earl of Bute থেকে নেওয়া, Monosperma অর্থ এক বীজীয় ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন